ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের অভিযোগে শেখ আমিনুর রহমান হিমু (৫৫) নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। তিনি দেশটিতে চাকরি দেওয়ার নামে অন্তত ৪শ লোকের কাছ থেকে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কাফরুল এলাকা থেকে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-৩) সহায়তায় আমিনুর রহমান হিমুসহ তিনজনকে আটক করা হয়। আটক অন্যরা হলেন- মো. নুর আলম (৩৬) ও বাবলুর রহমান (৩০)।
এসময় হিমুর দেহ তল্লাশি করে একটি বিদেশি পিস্তল ও গুলিভর্তি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানায়, ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজনের মূল সহযোগী হিমু। তিনি ২০১৯ সালে ভুয়া ডিমান্ড লেটার সংগ্রহ করে ৬০ জনকে ব্রুনাইয়ে পাঠান। এদের অনেকেই ঋণ করে ও জমিজমা বিক্রি করে ব্রুনাইয়ে গিয়ে কোনো কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছিল। পরবর্তীসময়ে তারা নিজ খরচে দেশে ফিরে আসেন।
হিমুর নিজের কোনো রিক্রুটিং লাইসেন্স নেই, তিনি নজরুল ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ও হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনাল আরএল ব্যবহার করে ব্রুনাইয়ে মানবপাচার করে আসছিলেন।
অসংখ্য ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন অপুর অন্যতম সহযোগী শেখ আমিনুর রহমান হিমু। মেহেদী হাসান বিজনের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ব্রুনাই মানবপাচার করতেন হিমু।
বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে র্যাব-৩ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিবুল হাসান।
তিনি বলেন, আটক হিমু সংসদ সদস্য পরিচয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেকার-যুবকদের টার্গেট করে ব্রুনাইয়ে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখাতেন। ব্রুনাইয়ের চাকরির কথা বলে প্রতিজনের কাছ থেকে তিন-চার লাখ টাকা নিতেন। কিন্তু ব্রুনাইয়ে কোনো চাকরি না পেয়ে উল্টো জেল খেটে মানবিক জীবনযাপন করতেন ভুক্তভোগীরা।
হিমু ব্রুনাইয়ে ভালো ভালো কোম্পানির কথা বলে মানবপাচার করতেন। কিন্তু ব্রুনাইতে সেসব কোম্পানির কোনো খোঁজ মেলেনি।
তিনি আরো বলেন, ব্রুনাইতে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক অবস্থান করছেন। শ্রমিকদের একটি বড় অংশ মানবপাচারকারী চক্রের মাধ্যমে ব্রুনাই গিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। ব্রুনাইতে বাংলাদেশি মালিকানায় প্রায় তিন হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত রয়েছে, যার অধিকাংশই নামসর্বস্ব।
এসব কোম্পানি ভুয়া বানোয়াট প্রকল্প দেখিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ব্রুনাই থেকে কর্মসংস্থান ভিসা বের করে দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিক্রি করে। ব্রুনাই যাওয়ার জন্য এক লাখ বিশ হাজার টাকা নির্ধারণ করা থাকলেও আর সেসব দালালদের মাধ্যমে প্রায় ৩-৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একজন কর্মীকে ব্রুনাই যেতে হয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাকিবুল হাসান বলেন, আইন অনুসারে ব্রুনাইতে একজন কর্মী সর্বোচ্চ দুই বছর অবস্থান করতে পারেন। দুই বছরে অভিবাসন ব্যয়ের টাকা তুলতে না পেরে অনেকেই ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত করে ফেলেন। এরপর তারা বাংলাদেশে না ফিরে মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে দুই হাজার ব্রুনাই ডলার দিয়ে পার্শ্ববর্তী সারওয়াক প্রদেশ হয়ে মালেশিয়ার পাচার হয়ে যাচ্ছেন।
মালেশিয়াতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নামে বর্তমানে কোনো ভিসা দেওয়া হয় না। মূলত ব্রুনাই বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানবপাচার কার্যক্রমের রুট এবং গন্তব্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্ট, বাংলাদেশি দালাল মিলে একটি সংঘবদ্ধ চক্র হয়ে কাজ করছে।
এদের উদ্দেশ্য হলো শ্রমিকদের কাছ থেকে মাসিক সুবিধা আদায় করা, শারীরিক নির্যাতন করা এবং তাদের বেকার রেখে দেশে ফেরত যেতে বাধ্য করা। যাতে তাদের ওয়ার্ক ভিসার বিপরীতে এভাবে আরো কর্মী নিতে পারেন।
জানা যায়, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ভিসা দালাল চক্রের মূল হোতা মেহেদী হাসান বিজনসহ সাতজনের পাসপোর্ট বাতিলের বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। পরবর্তীসময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পাসপোর্ট অধিদপ্তর মেহেদী হাসান বিজনসহ সাতজনের পাসপোর্ট বাতিল করে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের শিকার ভুক্তভোগীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ব্রুনাইয়ে অবস্থানকারী বাংলাদেশি দালাল মেহেদী হাসান বিজনকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন করে। মেহেদী হাসান বিজনের নামে দেশে ২০টি মামলা হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে আত্মগোপন করে আছেন।
Leave a Reply