জ্বালানি সংকটের মুখে থাকা বাংলাদেশে পরিশোধিত ডিজেল সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারদরে ডিজেল সরবরাহের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, গাজপ্রম ইপি ইন্টারন্যাশনাল চলতি বছর আগস্টে ঢাকায় অবস্থিত রুশ দূতাবাসের মাধ্যমে ডিজেল সরবরাহের এ প্রস্তাব পাঠায়।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, ‘গাজপ্রম ডিজেল সরবরাহের আগ্রহ প্রকাশ করে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমরা এখন এই প্রস্তাবটি বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে এগোনো যায়, তা নিয়ে কাজ করছি।’ গাজপ্রম ডিজেলের যে নমুনা পাঠিয়েছে, তা বাংলাদেশে ব্যবহৃত ডিজেল গ্রেডের সঙ্গে মেলে জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন করে জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যোগ করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। এখন সেই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। গাজপ্রমের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ডিজেল বিক্রির প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠানটি জিটুজি (সরকার-সরকার) ভিত্তিতে ডিজেল সরবরাহ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে বিপিসির কর্মকর্তারা জানান। ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানি পণ্য সরবরাহের জন্য গাজপ্রমের এই প্রস্তাবের আগে রাশিয়ার বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ঝারুবেজনেপ্ট, রসনেফ্ট ও তাতারাস্তান ট্রেড হাউস একই প্রস্তাব দিয়েছে।
বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এ কারণে দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনছে। ফলে রাশিয়া এশিয়ায় তেলের বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার ডলার সাশ্রয়ে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখেছে। ফলে বেড়েছে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা। এই অবস্থায় সরকার ডিজেল আনার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বাইরে অন্য বিকল্প খুঁজছে।
প্রস্তাবে গাজপ্রম বলেছে, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে দীর্ঘদিন থেকে অংশীদারত্বের মাধ্যমে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে জড়িত আছে। এখানে চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত ডিজেল জোগান তারা প্রস্তুত। বাংলাদেশ আগ্রহী হলে গাজপ্রম ডিজেল সরবরাহে আলোচনা চালিয়ে যেতে চায়।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার অনেক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান গেটওয়ে সুইফট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রধানত আর্থিক লেনদেন করে সুইফটের মাধ্যমে।
বিপিসির সূত্র জানিয়েছে, গাজপ্রম থেকে ডিজেল কিনলে কীভাবে আনা হবে এবং এর বিনিময় মূল্য কীভাবে পরিশোধ করা হবে, তা নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে ডিজেল আনতে পরিবহন ব্যয় কেমন হবে, তা ভাবাচ্ছে সরকারকে। কারণ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ডিজেল আমদানিতে পরিবহন খরচ কম। দূরত্বের কারণে রাশিয়া থেকে ডিজেল আমদানি তুলনামূলক ব্যয়বহুল।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রাশিয়া থেকে জ্বালানি পণ্য কেনার পথ ইতিমধ্যে বের হয়ে গেছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারত রাশিয়া থেকে জ্বালানি পণ্য ক্রয় অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের উচিত রাশিয়ার যেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই, তাদের মাধ্যমে লেনদেন করা। তিনি বলেন, ‘দাম পরিশোধ নিয়ে ভারত ও ইউরোপকে অনুসরণ করা উচিত। রাশিয়ার তেল নিলে আমার মনে হয় না যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কে তেমন কোনো ঝামেলা সৃষ্টি হবে।’ তবে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাতে পণ্য লেনদেন না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার তাগিদ দেন তিনি।
গাজপ্রম ডিজেলের যে নমুনা বিপিসিকে দিয়েছে, তাতে সালফারের উপস্থিতি ১০ পার্টস-পার-মিলিয়ন (পিপিএম), যা বাংলাদেশে অনুমোদিত সালফারের মাত্রার চেয়ে ৮০ শতাংশ কম। বিএসটিআই আমদানি করা ডিজেলে ৫০ পিপিএম পর্যন্ত সালফারের উপস্থিতি অনুমোদন করে।
বিপিসির তথ্যমতে, দেশে বছরে গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ মেট্রিক টনের মতো ডিজেলের চাহিদা আছে। এই চাহিদার পুরোটাই আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। মোট ডিজেলের ১০ শতাংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। আর বাকি ৯০ শতাংশের ব্যবহার হয় যানবাহনে।
Leave a Reply