তোষাখানা মামলায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং দেশটির রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানের গ্রেফতার ঠেকাতে পুলিশের সঙ্গে দিনভর সংঘর্ষ চলেছে পিটিআইয়ের কর্মী-সমর্থকদের। এ সংঘর্ষের জেরে মঙ্গলবার সকাল থেকে চেষ্টা চালালেও এখন পর্যন্ত ইমরানকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
দিকে সরকারের এই ‘অন্যায়’ ও ‘নিপীড়নমূলক’ গ্রেফতার অভিযান প্রতিহত করতে ইমরান খান নিজ দলের কর্মী-সমর্থকদের ‘লড়াই চালিয়ে যাওয়ার’ নির্দেশ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের বানিগালা এলাকায় ইমরান খানের বাসভবনের সামনে ও তার আশপাশের এলাকায় পুলিশ ও পিটিআই কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। বিকালের দিকে অবশ্য ইমরান খানের বাসভবন সংলগ্ন জামান পার্ক থেকে পিটিআই সমর্থকদের পুলিশ হটিয়ে দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জিও টিভির প্রতিবেদনে।
সংঘাতে উসকানি, বিচারককে হুমকি, তোষাখানা দুর্নীতি প্রভৃতি বিভিন্ন ঘটনায় পিটিআই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিভিন্ন থানা ও আদালতে ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গত দুই সপ্তাহে তোষাখানা দুর্নীতিসহ কয়েকটি মামলায় জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছেন পাকিস্তানের একাধিক আদালত।
ইমরানের আইনজীবীদের তৎপরতায় অন্যান্য মামলায় তার গ্রেফতারি পরোয়ানা আদালতে স্থগিত করা হলেও তোষাখানা মামলার ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। সোমবারের শুনানিতে ইসলামাবাদের সেশন জজ আদালত এ মামলায় পরোয়ানা স্থগিত বিষয়ক আবেদন নাকচ করে দেন। তারপর মঙ্গলবার ইমরানকে গ্রেফতার করতে তার বাসভবনের উদ্দেশে রওনা হয় পুলিশ।
কিন্তু পুলিশ তার বাসভবনের কাছাকাছি পৌঁছামাত্র বাসভবন সংলগ্ন সড়ক ও তার আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন পিটিআই কর্মী-সমর্থকরা। এ সময় পুলিশের দিকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ার পাশাপাশি লাঠি ও গুলতি হাতেও অনেককে তৎপর হতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
জবাবে পুলিশও জলকামান ব্যবহার ও লাঠিচার্জের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার বিক্ষুব্ধ পিটিআই কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে; কিন্তু তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ফের হামলা শুরু করেছেন কর্মী-সমর্থকরা।
ইসলামাবাদ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক সৈয়দ শাহজাদ নাদিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত আছেন। সেখানে সংক্ষিপ্ত এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল আদালতের নির্দেশ পালন করতে এখানে এসেছি কিন্তু পিটিআইয়ের কর্মী-সমর্থকরা সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে এই সংঘাত শুরু করেছে। তাদের হামলায় ইতোমধ্যে আমাদের বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহতও হয়েছেন।’
এদিকে নিজের গ্রেফতার ঠেকাতে সড়কে অবস্থান নেওয়া কর্মীদের উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি জনসাধারণকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ইমরান খান। মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে টুইট করা এক ভিডিওবার্তায় ইমরান খান বলেন, ‘পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছে। তারা ভাবছে আমাকে গ্রেফতারের পরও জাতি ঘুমিয়ে থাকবে; কিন্তু তাদের এই ভুল ধারণা ভেঙে দিতে হবে আপনাদেরকেই।’
তোষাখানা কী?
গত শতকের সত্তরের দশকে পাকিস্তানের সরকারি একটি বিভাগ হিসেবে তোষাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বিভাগটি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও অন্যান্য বিশিষ্ট জনদের দেওয়া উপহার জমা রাখে।
তোষাখানার নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা বা সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের পাওয়া সব উপহার অবশ্যই এই বিভাগে জমা দিতে হবে। যারা এসব উপহার পেয়েছেন তারা পরে এগুলো কিনে নিতে পারবেন। কিনে নেওয়ার পর এসব উপহার বিক্রির বিষয়টি অবৈধ না হলেও অনেকেই এটিকে অনৈতিক বা নীতিগতভাবে ভুল বলে মনে করেন।
ইমরানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয় তাতে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় থাকাকালে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জিনিসের ৫৮টি বাক্স উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন।
গত আগস্টে পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের সবচেয়ে বড় শরিক দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ- নওয়াজের (পিএমএলএন) সদস্য মোহসিন নওয়াজ রানঝা ইমরানের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় তোষাখানা থেকে বিদেশি বিশিষ্টজনদের দেওয়া উপহার কিনলেও নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে সেগুলোর উল্লেখ করেননি।
এ সম্পর্কে গত ২২ আগস্ট পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির স্পিকার রাজা পারভেজ আশরাফ নির্বাচনক কমিশনকে দেওয়া এক চিঠিতে ইমরান খানকে ‘অসৎ’ ঘোষণা করে তাকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজের ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় তোষাখানা থেকে নামমাত্র মূল্যে এসব উপহার নিয়েছেন এবং এসব উপহারের অধিকাংশই তিনি বিক্রি করেছেন।
উপহারের মধ্যে কিছু দামি হাতঘড়িও রয়েছে। এসব উপহারের আনুমানিক মূল্য ১৪ কোটি ২০ লাখ রুপি। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ইমরান খান এসব উপহার গ্রহণ করেছিলেন বলে আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন স্পিকার।
Leave a Reply