বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লি যাচ্ছেন শুক্রবার। এ সফরকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে তাতে সফরের সময়ে উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে।
তবে এ সফরে দু’দেশের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে তার বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।
আবার সাধারণত এ ধরনের সফরের আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিং করে সফর সম্পর্কে জানানোর রেওয়াজ থাকলেও এবার এখনো তা হয়নি।
কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব ঢাকায় নেই। আর তাদের অনুপস্থিতিতে এই সফর নিয়ে অন্য কাউকে কিছু বলার নির্দেশনাও দেয়া হয়নি।
বরং সফরটির কার্যক্রম তত্ত্বাবধান হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সফর সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছে বুধবার।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে শুক্র ও শনিবার দিল্লি অবস্থান করবেন।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, এ দফায় সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রথম বিদেশ সফর ভারতে করছেন। কূটনীতি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে থেকে এ সফরের উল্লেখযোগ্য দিক এটাই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, শেখ হাসিনার এ সফর উভয় দেশের সরকারের ‘পরস্পরের প্রতি আস্থা ও নির্ভরতার একটি বহিঃপ্রকাশ ঘটবে’।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন, তারা ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে চান যাতে করে সব সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে চলতি বছরের সাতই জানুয়ারি বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে।
অন্যদিকে ভারতেও সাধারণ নির্বাচনের পর গত ১০ জুন নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনাসহ আরো কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান।
বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চাত্য দেশগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের ‘ওপর চাপ তৈরি করলেও’ শেষ পর্যন্ত ভারতের সমর্থনে বিরোধী দলহীন নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়েছে বলে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করে থাকে।
দিল্লি সফরে শেখ হাসিনা কী করবেন?
ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে ২২ জুন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিল্লির ফোরকোর্টস্থ রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী সশস্ত্র সালাম গ্রহণ ও গার্ড অব অনার পরিদর্শন করবেন।
সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষে শেখ হাসিনা রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করবেন।
ওই দিনই হায়দ্রাবাদ হাউজে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে একান্ত বৈঠক ও প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনা হবে।
সেখানে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ও চুক্তি বিনিময়ের পর দুই নেতা প্রেস বিবৃতি দিবেন।
একই সাথে শেখ হাসিনার সম্মানে মধ্যাহৃ ভোজ, পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ফটোসেশনের আয়োজন হবে।
এর আগে শুক্রবার দিল্লি পৌঁছানোর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
এছাড়া শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির সাথেও সাক্ষাত করবেন।
কী নিয়ে সমঝোতা বা চুক্তি?
এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে না দেয়া হলেও ঢাকায় কর্মকর্তারা যে ধারণা দিয়েছেন তা হলো ভারতের সাথে আগে হওয়া ঋণচুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই চাইছিল যে- পেঁয়াজ বা চিনির মতো জরুরি দরকারি পণ্যগুলোর বাংলাদেশে আমদানির সুযোগ যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে ভারত যেন তা নিশ্চিত করে।
এর আগে অনেক বারই দেখা গেছে পেঁয়াজসহ কিছু পণ্যের ওপর ভারত আকস্মিকভাবে রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল।
এবার এনিয়ে আলোচনা ও সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
যদিও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা নতুন করে আলোচনায় আসার প্রেক্ষাপটে দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনাতেও এটি আসতে পারে।
কারণ চীন এ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চাইছে অনেক দিন ধরেই। আবার ভারতও জানুয়ারির নির্বাচনের পরে এ প্রকল্পে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
‘এখানে চূড়ান্তভাবে কী হবে বলা মুশকিল। হয়তো বাংলাদেশে চীনের ফুটপ্রিন্ট বেড়ে যাচ্ছে এ নিয়ে ভারতের তরফ থেকে উদ্বেগও আসতে পারে। আবার বাংলাদেশ হয়তো ভারতকে বুঝিয়ে বলতে পারে যে- এনিয়ে ভারতের নিরাপত্তা-জনিত উদ্বেগের কোনো কারণ থাকবে না’।
‘সেক্ষেত্রে একটা লিমিটেড ওয়েতে (সীমিতভাবে) চীনকে তিস্তা পরিকল্পনায় কাজ করতে দিতে উভয় পক্ষ একমতও হতে পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সফরের রাজনৈতিক গুরুত্ব
তৌহিদ হোসেন বলছেন, নির্বাচনের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফর আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম কোনো বিদেশী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনাকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন- এটাই এ সফরের মূল বৈশিষ্ট্য।
‘দীর্ঘদিন ধরে দুই নেতা দুই দেশে ক্ষমতায় আছেন। সঙ্গত কারণেই কিছু বিষয় আলোচনায় আসবে। ভারতীয় ঋণচুক্তি বাস্তবায়নের গতি খুব ধীর। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই কথা হবে। আর তিস্তা পরিকল্পনার বিষয়টিও আসতে পারে। আর কমন কিছু বিষয় তো আছেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় সফরগুলো ছাড়াও দুই নেতা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে সাইডলাইনে বৈঠক করেছেন।
তৌহিদ হোসেন বলছেন, দুই দেশের মধ্যে এখন যে সম্পর্ক আছে তাতে ভারত হয়তো ভাবতে পারে যে- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাল দিতে চীনের সহযোগিতা দরকার, কারণ চীন যা দিতে পারে সেটি দেয়ার সক্ষমতা ভারতের নেই।
‘এমনটি হলে তিস্তা পরিকল্পনার কাজ চীনকে দেয়ার বিষয়ে অগ্রগতি হলেও হতে পারে। আরো নতুন কোনো বিষয় আলোচনায় আসে কি-না সেটি দু দেশের যৌথ বিবৃতি বা ঘোষণা এলে জানা যাবে’।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেছেন নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চাপ তৈরি করেছিল তার বিরুদ্ধে ভারতই মূলত শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
‘যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত- এ তিনটি দেশই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভারত সরাসরি এই সরকারের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে নির্বাচনের সময়। ফলে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক সভায় দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন তারা ভারতের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে চান কারণ সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হলে আলোচনার টেবিলে সমস্যার সম্মানজনক সমাধান সম্ভব।
‘ভারতের সাথে কম্প্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ করছি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থেই। জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে কারো সাথে সম্পর্ক করব না। ভারতের সঙ্গে বৈরিতা আমরা করতে চাই না। বন্ধুত্বপূর্ণ, ভারসাম্যমূলক ও সম্মানজনক পারস্পরিক কূটনীতি চাই,’ বলছিলেন কাদের।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply