ইরানের জন্য এই মুহূর্তে স্বস্তির একমাত্র দিক হচ্ছে, রাশিয়ার সঙ্গে গত জানুয়ারি মাসে নতুন করে স্বাক্ষরিত ২০ বছরের কৌশলগত চুক্তি নবায়নের অনুমোদন মিলেছে ইরানের পার্লামেন্টে গত ১০ জুন, যা রাশিয়ার পার্লামেন্ট গত এপ্রিল মাসেই অনুমোদন দিয়েছে। সেই সঙ্গে এই চুক্তির আলোকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানে নতুন করে আটটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনিতেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এত অস্বস্তি এবং এককথায় তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের গলার কাঁটা—এই সবকিছুই রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন সমর্থনপুষ্ট। রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই কৌশলগত চুক্তির আলোকে নতুন সিদ্ধান্ত এটিই জানান দিচ্ছে যে রাশিয়া এখন থেকে আর মুখ লুকিয়ে নয়, সরাসরি ইরানের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে স্বমহিমায় আবির্ভূত হতে চাইছে। বোঝাই যাচ্ছে, রাশিয়া-ইরানের এই উদ্যোগ কেবল জ্বালানি নয়, একটি যৌথ কৌশলগত সম্পর্ক, যার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একা নয়।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে নতুন করে ইরানের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণাটি এমন সময় এলো, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দুই মাসের একটি আলটিমেটাম দেন, যার জবাবে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে ইরান কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করবে না এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বন্ধ করবে না। অন্যদিকে রাশিয়ার তরফ থেকে প্রেসিডেন্ট পুতিন সব সময়ের জন্যই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে রাশিয়ার কোনো স্থাপনায় কোনো ধরনের হামলার পরিণাম হবে ভয়াবহ। এর মধ্য দিয়ে কার্যত এটিই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে ইরানের অভ্যন্তরে তাদের পরমাণু কর্মসূচিতে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং এসব লক্ষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের তরফ থেকে যদি কোনো হামলা পরিচালিত হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে রাশিয়াকেও এর জবাব দিতে বাধ্য করা হবে।
এসব তৎপরতা খুব দ্রুতই ঘটছে এবং এমন এক সময় ঘটছে, যখন পরিস্থিতি গত দুই মাসের তুলনায় অনেক বেশি অস্থির হয়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে সব জল্পনাকে সত্য করে ইসরায়েল হামলা করে বসেছে। রাশিয়া এই পরিস্থিতিতে ইরানের ওপর এই হামলাকে নিজেদের আত্মমর্যাদার ওপর একটি আঘাত বিবেচনায় নিয়ে যদি ইরানের পাল্টা হামলাকে সমর্থন দিয়ে বসে, মার্কিনরা তাদের ‘চির মিত্র’ ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায় (বাস্তবিক অর্থে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায়) কী পদক্ষেপ নিতে পারে, সেটি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে যথেষ্টই ঘাম ঝরাতে হবে। ইরানকে যদি তাদের প্রক্সিদের দুর্বল অবস্থানজনিত কারণে দুর্বল ভাবা হয়, তাহলে বড় ভুল করা হবে। তা ছাড়া পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইসরায়েল যেভাবে ইরানকে আঘাত করেছে, এই সবকিছুই ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাওয়ার সঙ্গে মিলে গেছে। এখন তাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিষয় সামনে চলে এসেছে।
বর্তমানের পরিস্থিতি যে সত্যকে সামনে তুলে এনেছে, তা হচ্ছে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের শক্তির কাছে ইরান অনেকটাই দুর্বল, তাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ ছায়া হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় তারাও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। তারা এখন পর্যন্ত একা, সেই সঙ্গে ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ একটি নিখুঁত হামলা চালাতে ইসরায়েলকে সহায়তা দিয়েছে। বলা যায়, ইরানের অনেক গোপন বিষয়ই আর গোপন নয়, মোসাদের জানা, যা ইরানের জন্য আরো বিপর্যয়কর হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে নিবৃত্ত করার কোনো চেষ্টা করবে বলে মনে হচ্ছে না, বরং তারা যৌথভাবে তাদের মিশন ইরানের ‘পরমাণু সামর্থ্য’কে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এটি উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে ইরানের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য যদি সফল হয়, তাহলে তাদের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হতে পারে সিরিয়া ও তুরস্ক। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের সমাধান এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের উদ্যোগ অসফল। যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ইউরোপের অভ্যন্তরেও প্রশ্নবিদ্ধ। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি গোটা বিশ্বেই বর্তমানে সমালোচিত। রাশিয়া ও চীন একাট্টা হয়ে যদি বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়, তাহলে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি বড় সুযোগ হতে পারে। সব দিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সবকিছুকে যতটা সহজ মনে করছে, দিনশেষে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিস্তৃত এবং প্রলম্বিত যুদ্ধের ঘানি যদি তাদের টানতে হয়, তাহলে তাদের জন্য অতীতের অনেক তিক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply