ইরান-ইসরায়েল সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা ইরান-ইসরায়েল সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা – ajkalbd24.com
  1. admin@ajkalbd24.com : admin : H.M Aslam
  2. akazadjm@gmail.com : A K Azad : A K Azad
  3. ajkalbd24.com@gmail.com : ajkalbd24 : Niaz Mohammad
  4. hafijakhan804@gmail.com : ajkal1 : ajkal1
রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫, ০৫:২৭ পূর্বাহ্ন

ইরান-ইসরায়েল সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা

ড. ফরিদুল আলম
  • আপডেটের সময় : সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫
  • ৬ সময় দর্শন
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ষষ্ঠ দফা পরমাণু আলোচনা থেকে সরে এসেছে ইরান। এত দিন ধরে আলোচনার আড়ালে কার্যত ইসরায়েলকে ইরানের অভ্যন্তরে হামলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে—ইরানের কাছে বিষয়টি এখন স্পষ্ট। তারা জোর দিয়ে বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ঘাঁটিগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তু থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে ইরানকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে আরো ভয়ানক পরিণতির বার্তা দিয়েছে।

এদিকে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের এই বীরত্বে উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি আরো হামলার বিষয়ে আগাম বার্তা দেওয়া হয়েছে। ইরান আপাতত একাই ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর দেশ নয়, তাদের ভরসার জায়গা এখন তাদের কৌশলগত মিত্র রাশিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের রয়েছে কৌশলগত সম্পর্ক।
ইরানের পক্ষে এই দুইয়ের সংমিশ্রণ ঘটলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এই হামলায় নিহত হয়েছেন। ধারণা করা যাচ্ছিল, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের কমপক্ষে ১৫টি পারমাণবিক বোমা বানানোর সক্ষমতা ছিল। এই সক্ষমতা যদি এখনো বহাল থাকে, তাহলে ইরান নিশ্চয়ই এ বিষয়ে আরো আগ্রাসী হবে, হতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধ।
হামলা হবে, এটি অনুমেয় ছিল। ইরানও জানত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার আড়ালে কয়েক মাস ধরেই ইসরায়েলকে দিয়ে ইরানে হামলার একটি ছক কষা হচ্ছিল। যদিও ইরানের মাটিতে ইসরায়েলের আকস্মিক এই হামলার বিষয়ে কিছুই জানে না বলে প্রথমে জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই এটি জানতেন বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই উদ্যোগ নিয়ে খোদ ওয়াশিংটনের অন্দরে বাইডেন প্রশাসনের সময় থেকেই জোর তৎপরতা চলে গত জানুয়ারি মাস থেকে। সে সময় বাইডেনের উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রক্সিদের মধ্যে হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতিদের শক্তিমত্তা দুর্বল হওয়াকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তার পরমাণু কর্মসূচি আর বাড়তে না দেওয়ার উপায় হিসেবে এই হামলার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।
সে সময় বাইডেনের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত দেওয়া না হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার আজকের এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের ‘নরকের স্বাদ’ ভোগ করতে হবে মর্মে হুঁশিয়ারি দেন। এরপর শুরু হয় আলোচনার নামে প্রহসন। প্রথম দিকে ইরানের সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে মার্কিনদের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসার বিষয়ে নিরুৎসাহ দেখানো হলেও কৌশলগত কারণে এই আলোচনায় অংশ নেয় তারা। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ভেন্যুতে পাঁচ দফার আলোচনা শেষে কোনো ফলাফল যখন আসছিল না, আলোচনাকে আবার পুরোপুরি বাতিল না করে ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে তাঁদের শর্ত মেনে নিয়ে ইরান যদি পরমাণু কর্মসূচি থেকে সম্পূর্ণ সরে না আসে, তাহলে এর জন্য কঠিন পরিণতি ভোগের হুঁশিয়ারি দেন। এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলের তরফ থেকেও যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়ে আসছিল, সেসব নিরীক্ষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে ইরানের মাটিতে তাদের পরমাণু স্থাপনার ওপর হামলা করাই মার্কিন-ইসরায়েল শক্তির মূল লক্ষ্য।ইসরায়েলের এই হামলা থেকে তাদের দিক থেকে যেন ইরানকে এই বার্তাই দিল, ‘এসো যুদ্ধ করি।’ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে চালানো এই হামলায় স্থাপনার বাইরে ইরানের যে ক্ষতি হয়েছে, তা নজিরবিহীন। ইরানের সেনাপ্রধান, বিপ্লবী গার্ডের প্রধান, পরমাণুপ্রধান, যিনি ২৫ বছর ধরে এই দায়িত্ব সামলে আসছেন, ছয়জন পরমাণুবিজ্ঞানীসহ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ‘যত দিন প্রয়োজন হবে’, তত দিন ধরে এই অপারেশন ‘রাইজিং লায়ন’ নামক হামলা পরিচালনা করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী বেনয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ইরানের তরফ থেকে ‘পাল্টা হামলা অনিবার্য’ ধরে নিয়েই ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে অর্থাৎ তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। প্রশ্ন হচ্ছে, কী করবে ইরান, ইসরায়েলের এই আহবান মেনে যুদ্ধ করবে, নাকি আর হামলার শিকার যেন হতে না হয় সেটি নিশ্চিতকল্পে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসতে চাইবে এবং তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনা মেনে নেবে? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এর কোনোটিরই সম্ভাবনা নেই। তাহলে যা দাঁড়ায়, আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধ দেখতে যাচ্ছে বিশ্ব, যা হতে পারে ভয়াবহ, যেখানে জড়িয়ে পড়তে পারে পরাশক্তিগুলো—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এমনকি চীনও।

ইরানের জন্য এই মুহূর্তে স্বস্তির একমাত্র দিক হচ্ছে, রাশিয়ার সঙ্গে গত জানুয়ারি মাসে নতুন করে স্বাক্ষরিত ২০ বছরের কৌশলগত চুক্তি নবায়নের অনুমোদন মিলেছে ইরানের পার্লামেন্টে গত ১০ জুন, যা রাশিয়ার পার্লামেন্ট গত এপ্রিল মাসেই অনুমোদন দিয়েছে। সেই সঙ্গে এই চুক্তির আলোকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানে নতুন করে আটটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনিতেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এত অস্বস্তি এবং এককথায় তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের গলার কাঁটা—এই সবকিছুই রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন সমর্থনপুষ্ট। রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই কৌশলগত চুক্তির আলোকে নতুন সিদ্ধান্ত এটিই জানান দিচ্ছে যে রাশিয়া এখন থেকে আর মুখ লুকিয়ে নয়, সরাসরি ইরানের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে স্বমহিমায় আবির্ভূত হতে চাইছে। বোঝাই যাচ্ছে, রাশিয়া-ইরানের এই উদ্যোগ কেবল জ্বালানি নয়, একটি যৌথ কৌশলগত সম্পর্ক, যার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একা নয়।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে নতুন করে ইরানের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণাটি এমন সময় এলো, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দুই মাসের একটি আলটিমেটাম দেন, যার জবাবে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে ইরান কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করবে না এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বন্ধ করবে না। অন্যদিকে রাশিয়ার তরফ থেকে প্রেসিডেন্ট পুতিন সব সময়ের জন্যই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে রাশিয়ার কোনো স্থাপনায় কোনো ধরনের হামলার পরিণাম হবে ভয়াবহ। এর মধ্য দিয়ে কার্যত এটিই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে ইরানের অভ্যন্তরে তাদের পরমাণু কর্মসূচিতে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং এসব লক্ষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের তরফ থেকে যদি কোনো হামলা পরিচালিত হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে রাশিয়াকেও এর জবাব দিতে বাধ্য করা হবে।

এসব তৎপরতা খুব দ্রুতই ঘটছে এবং এমন এক সময় ঘটছে, যখন পরিস্থিতি গত দুই মাসের তুলনায় অনেক বেশি অস্থির হয়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে সব জল্পনাকে সত্য করে ইসরায়েল হামলা করে বসেছে। রাশিয়া এই পরিস্থিতিতে ইরানের ওপর এই হামলাকে নিজেদের আত্মমর্যাদার ওপর একটি আঘাত বিবেচনায় নিয়ে যদি ইরানের পাল্টা হামলাকে সমর্থন দিয়ে বসে, মার্কিনরা তাদের ‘চির মিত্র’ ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায় (বাস্তবিক অর্থে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায়) কী পদক্ষেপ নিতে পারে, সেটি নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে যথেষ্টই ঘাম ঝরাতে হবে। ইরানকে যদি তাদের প্রক্সিদের দুর্বল অবস্থানজনিত কারণে দুর্বল ভাবা হয়, তাহলে বড় ভুল করা হবে। তা ছাড়া পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইসরায়েল যেভাবে ইরানকে আঘাত করেছে, এই সবকিছুই ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাওয়ার সঙ্গে মিলে গেছে। এখন তাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিষয় সামনে চলে এসেছে।

বর্তমানের পরিস্থিতি যে সত্যকে সামনে তুলে এনেছে, তা হচ্ছে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের শক্তির কাছে ইরান অনেকটাই দুর্বল, তাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ ছায়া হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় তারাও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। তারা এখন পর্যন্ত একা, সেই সঙ্গে ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ একটি নিখুঁত হামলা চালাতে ইসরায়েলকে সহায়তা দিয়েছে। বলা যায়, ইরানের অনেক গোপন বিষয়ই আর গোপন নয়, মোসাদের জানা, যা ইরানের জন্য আরো বিপর্যয়কর হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে নিবৃত্ত করার কোনো চেষ্টা করবে বলে মনে হচ্ছে না, বরং তারা যৌথভাবে তাদের মিশন ইরানের ‘পরমাণু সামর্থ্য’কে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এটি উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে ইরানের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য যদি সফল হয়, তাহলে তাদের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হতে পারে সিরিয়া ও তুরস্ক। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের সমাধান এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের উদ্যোগ অসফল। যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ইউরোপের অভ্যন্তরেও প্রশ্নবিদ্ধ। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি গোটা বিশ্বেই বর্তমানে সমালোচিত। রাশিয়া ও চীন একাট্টা হয়ে যদি বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়, তাহলে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি বড় সুযোগ হতে পারে। সব দিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সবকিছুকে যতটা সহজ মনে করছে, দিনশেষে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিস্তৃত এবং প্রলম্বিত যুদ্ধের ঘানি যদি তাদের টানতে হয়, তাহলে তাদের জন্য অতীতের অনেক তিক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর