আজকাল ডেস্ক।।কাউকে চাকরি দেওয়া, কাউকে পদোন্নতির ব্যবস্থা করে দেওয়া, আবার কাউকে চাকরির লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়া— এমন নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত চার-পাঁচ বছরে কারও কাছে এক লাখ, কারও কাছে দুই লাখ এমন বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিলেও যেসব প্রলোভন দেখিয়েছেন, তার কোনোটিই পূরণ করতে পারেননি। তবে চাকরির লোভে পড়ে ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দেওয়া পরিবারগুলো আর সে টাকা উদ্ধার করছে পারছে না। উল্টো টাকা চাইতে গেলে হুমকি এবং মামলার ভয় দেখানো হচ্ছে তাদের।
দিনের পর দিন বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার বড় রঘুনাথপুর গ্রামে এমনই প্রতারণার জাল বিছিয়ে আসছেন প্রিন্স এলাহী। নিজেকে ব্যারিস্টার পরিচয় দিলেও এলাকাবাসী বলছেন, তিনি আদলতে কোনো আইনজীবী নন। প্রতারণা করার জন্যই এরকম একটি পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করিয়েছিলেন তিনি। এলাকাবাসীর দাবি— এই প্রতারককে আইনের আওতায় এনে তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
‘ব্যারিস্টার’ প্রিন্স এলাহীর প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করলেন হাসান মাহমুদ। একই এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, প্রিন্স কামরান ওরফে ব্যারিস্টার প্রিন্স ইলাহী আসলে ভুয়া ব্যারিস্টার। কেউ বলতে পারে না তিনি কবে, কোথা থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেছেন। তার প্রকৃত নাম প্রিন্স কামরান। তার বাবা স্কুল শিক্ষক হাবীবুর রহমান।
হাসান মাহমুদ আরো বলেন, বরিশাল আদালতে চাকরি হবে এমন আশ্বাস দিয়ে ডাচ বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চার লাখ টাকা নেন প্রিন্স। গরু পালতাম আমরা। সেই গরু বিক্রি করে দুই লাখ টাকা দিয়েছি। ৪০ কড়া (৮০ শতাংশ) জমি বন্ধক রেখে মোট তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা তাকে দেই। এরপর আবারও টাকা চাইলে যত গাছ-গাছালি আর হাঁস-মুরগী ছিল, সব বিক্রি করে বাকি ৪০ হাজার টাকাও দেই। সেটা ২০১৬ সালের কথা। সব টাকা বুঝে নিলেও আমরা চাকরি এখনো হয়নি। সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে সংসারও চলে না। কিছুদিন আগে আমার মা স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে আছেন। টাকা চাইতে গেলে উল্টো মামলার ভয় দেখান। বন্ধক জমি কোনোদিন বের করতে পারব কি না, তাও জানি না। এখন আর গরু পালার মতো টাকাও নেই। আর বেশিরভাগ সময় প্রিন্সের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকে। এলাকার জনপ্রতিনিধিদেরও জানিয়েছি, তবু টাকা পাচ্ছি না।
আরেক ভুক্তভোগী মো. রিপন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, আমাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমএলএসএস পদে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রিন্স। চাকরি না পাওয়ায় তার কাছে টাকা ফেরত চাইলে উল্টো আমাকেই পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বলে, আমি একজন ব্যারিস্টার। জানিস কত কিছু করতে পারি?
আরেক ভুক্তভোগী দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমার ছোট ভাইকে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে নিয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। ২০১৭ সালে সেই টাকা দিয়েছি। এখন ২০২০ সাল। চাকরিও নেই, টাকাও নেই। টাকা চাইলে বলেন, টাকা দেবে। কিন্তু আজকাল করতে করতেই বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে।
জাকারিয়া নামে একজন বলেন, বাংলাদেশ বেতারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে নিয়েছে ছয় লাখ ৯০ হাজার টাকা। চাকরি না হলে গত দুই বছরে এক লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। বাকি টাকার কোনো হদিস নাই। এখন টাকা চাইলে অস্বীকার করে বলেন, কিসের টাকা, তোরা কোনো টাকা পাবি না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের হাবিবুর রহমানের ছেলে প্রিন্স কামরান। তিনি ২০০২ সালে জিপিএ ৩ দশমিক ১৩ পেয়ে এসএসসি এবং দুই বার অকৃতকার্য হওয়ার পর তৃতীয় চেষ্টায় ২০০৬ সালে জিপিএ ৩ দশমিক ১০ নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর কিছুদিন ঢাকায় ছিলেন। এলাকাবাসী বলছেন, এরপর আচমকাই তারা জানতে পারেন, প্রিন্স কামরান ব্যারিস্টার হয়েছেন। নামের সঙ্গে ব্যারিস্টার ডিগ্রি লাগিয়ে ও জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের নেতা পরিচয়ে এলাকায় পোস্টারিং করতে শুরু করেন। এই পরিচয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রিন্স এলাহীর পাসপোর্টের কপিতে যুক্তরাজ্যের ভিসার কোনো প্রমাণ নেই (পাসপোর্ট নম্বর-বিএফ-০৭৫৩৭৩৬)। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের চারটি ইনস অব কোর্ট, ব্যারিস্টার স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড অব ইউকে’তে আলাদা আলাদা ইমেইল দিয়ে এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে খোঁজ নিয়েও ব্যারিস্টার প্রিন্স ইলাহী বা প্রিন্স কামরান নামে কারও ব্যারিস্টার ডিগ্রি লাভের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার অনেক ছবি আছে। সুকৌশলে এসব ছবি তুলে সেগুলো গ্রামের সবাইকে দেখিয়ে নিজের প্রভাবের প্রমাণ তুলে ধরেন তিনি। আর তারপরই শুরু হয় তার প্রতারণা। কাউকে চাকরি দেওয়া, কাউকে পদোন্নতি দেওয়া, কাউকে টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দেওয়া— এমন নানা প্রলোভনে টাকা নিয়ে প্রতারণা করে আসছেন প্রিন্স। গ্রামের প্রায় ৪০টি পরিবার তার এমন প্রতারণার শিকার। একেকজনের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অসহায় মানুষগুলো টাকা ফেরত না পেলেও গ্রামের বাড়িতে বিলাসবহুল বাড়ি গড়েছেন প্রিন্স।
ব্যারিস্টার প্রিন্স এলাহী সম্পর্কে জানতে চাইলে বাকেরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন ডাকুয়া বলেন, তার নাম কামরান। এলাকার সবাই এবং তার আত্মীয়-স্বজনরাও তাকে কামরান বলেই ডাকে। ঢাকায় গিয়ে হঠাৎ করে সে প্রিন্স এলাহী হয়ে যায়। আবার নামের আগে ব্যারিস্টার। ভুয়া ব্যারিস্টার। লন্ডন কেন, বাংলাদেশের বাইরে একটি দেশেও যায়নি। তার পাসপোর্ট দেখেছি, সেখানে কোনো দেশের ভিসাও লাগেনি। চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেক মানুষের টাকা-পয়সা নিয়ে মেরে দিয়েছে। লোকজন এসে অভিযোগ করে। এরপর থেকে কাছে ঘেঁষা তো পরের কথা, আশপাশের ১০ কিলোমিটারের মধ্যেও তাকে আসতে দেই না।
নিজেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দাবি করে পোস্টারিং করেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র লোকমান বলেন, শুরুর দিকে পোস্টার লাগিয়েছিল। এরপর যখন জানতে পারি সে ভুয়া ব্যারিস্টার, তারপর থেকে আমার এলাকায় এসব করতে নিষেধ করেছি। আর করেনি। জননেত্রী শেখ হাসিনা নামে শুধু একটা দোকান খুলে অনেকের সাথে প্রতারণা করেছে মাত্র।
কথা হয় কামরানের বাবা হাবীবুর রহমানের সঙ্গেও। তিনি বলেন, ছেলে আমার ঢাকায় ছিল। সেখানে পড়ালেখা করেছে। এলাকায় এসে অনেকের টাকা নিয়েছিল, যা ভুক্তভোগীরা বাড়িতে এসে জানালে জানতে পারি। পরে অনেককে বেশ কিছু টাকা পরিশোধ করেছি। আমি আর কী করতে পারি!
বার-অ্যাট-ল পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হাবীবুর রহমান বলেন, ছেলে লন্ডনে যায়নি ঠিকই, তবে ঢাকায় নাকি অনলাইনে ব্যারিস্টারি পড়া যায়। ছেলে জানিয়েছে, অনলাইনেই পড়েই ব্যারিস্টার হয়েছে।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিকুল ইসলাম সোহেল বলেন, বাংলাদেশে থেকে কোনো মাধ্যমেই বার-অ্যাট-ল পড়ার সুযোগ নেই। এই ডিগ্রি নিতে তাকে অবশ্যই ইংল্যান্ড যেতে হবে, অবশ্যই চারটি ইনের সদস্য হতে হবে এবং ডিনারে অংশ নিতে হবে। এছাড়া সেখানকার কারিকুলামে পড়ালেখাও করতে হবে। এটা না করেই যদি কেউ নিজেকে ব্যারিস্টার দাবি করেন, তিনি একজন ভুয়া ব্যারিস্টার হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
এ বিষয়ে জানার জন্য অভিযুক্ত প্রিন্স ইলাহী ওরফে কামরানের ব্যক্তিগত তিনটি মোবাইল নম্বরে (গ্রামীণ, রবি ও এয়ারটেল) কয়েকদিন ধরে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। সাংবাদিক পরিচয় জানিয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে মেসেজ পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি তিনি।
Leave a Reply