নিজস্ব প্রতিবেদক::ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশি জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে হামলার ঘটনায় নিহত নাবিক হাদিসুরের মরদেহের জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল তাঁর পরিবার। অন্তত ছেলের মরদেহ ছুঁয়ে দেখার আশা মেটাতে নীরব অপেক্ষা দীর্ঘ হতে হতে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে, আবার সেটা গালে শুকিয়ে লম্বা দাগে পরিণত হচ্ছে। গালের এই অশ্রু শুকানোর দাগ হয়তো স্বজন হারানোয় হৃদয়ে লাগা দাগেরই প্রতিচ্ছবি। বিমানাবন্দরের সিআইপি গেটের বাইরে দাঁড়ানো হাদিসুরের ছোট দুই ভাইসহ বাবা, মা আর অন্য স্বজনেরা। ভেতরের গেটে মেজ ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্সকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে দেখা গেল দুপুর ১টার দিকে। গণমাধ্যমকর্মীদের ধরে ধরে প্রিন্স অভিযোগ করছিলেন, ‘ভাই, বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষ আমাদের জানাইতেছে না আমার ভাইয়ের লাশ কোনো দিক দিয়া আনবে। আমার বাবা-মায়ে অপেক্ষা করছে, জানতে চাইতেছে। আমি জবাব দিতে পারতেছি না।’ তৃষ্ণায় ঠোঁট চাটতে চাটতে একটু পানি পানের অনুরোধ জানান প্রিন্স। পানি পানের পরেই, ‘আমারে নিয়ে আমার ভাইয়ের কত স্বপ্ন আছিল’ বলেই লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। এরপর বুক চাপড়ে অস্পষ্ট স্বরে আর্তনাদ আর গড়াগড়ি।
এই কান্না যে সংক্রামক, তা প্রমাণ করতে মুহূর্তেই মূল সিআইপি গেট থেকে বাইরের গেটে অপেক্ষারত বাবা-মা আর সবার ছোটভাই তারেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।দীর্ঘ সময়ের অনাহার, অর্ধাহার আর তৃষ্ণার্ত বুক নিয়ে কান্নারত অবস্থায় গণমাধ্যমে কথা বলতে চাইলেন হাদিসুরের বাবা রাজ্জাক হাওলাদার। চোখে কোনো জল না থাকলেও ভাঙা গলায় ছেলের কথা বলতে চাইলেন, কিন্তু তা আর বোঝা গেল না। তবে ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্য এক বৃদ্ধ বাবার আকুতি বোঝা গেল সহজেই।
মা রাশিদা বেগম কান্না করতে করতে দুর্বল হয়েছেন অনেক আগেই। তবু ছেলেকে শেষবারের মতো একটু ছুঁয়ে দেখার আকুতি জানাতে বারবার শক্তি সঞ্চয় করে কথা বলতে চাইছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আর আমারে ভালো-মন্দ খাইতে কইব না। শেষবার (গত বুধবার) যখন কথা হইছে, আমার বাবা আমারে কইছিল ভালো-মন্দ খাওয়াদাওয়া করতে। এখন আর কেউ কইব না এই কথা। আমার পোলারে আমি শেষ দেখা দেখতে চাই। ওরা কয় না ক্যান কোন দিক দিয়া আইব আমার পোলা?’
হাদিসুরের চাচাতো ভাই সোহাগ হাওলাদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ভাই (হাদিসুর) মারা যাওয়ার সঙ্গে তাঁদের পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষ আর থাকল না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, হাদিসুরের ছোট দুই ভাইয়ের জন্য যেন চাকরির ব্যবস্থা করা হয়।’
আজ দুপুর ১২টা ১ মিনিটে সমৃদ্ধির ২৮ নাবিক নিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে টার্কিশ এয়ারলাইনসের টিকে-৭২২। অথচ সকাল থেকেই অপেক্ষায় আছে এসব নাবিকের স্বজনেরা। বিমান অবতরণ করলে দুপুর ১টা ৫৩ মিনিটে তাঁরা ইমিগ্রেশন ও বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বের হয়। এক বুক আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে অন্য নাবিকদের ফিরে আসা দেখছিল হাদিসুরের পরিবার।
Leave a Reply